কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানিঃ বলি হবেন আর কত নারী?

যুগটা নারীর ক্ষমতায়নের। কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে নারীরাও। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা এখনো বৈষম্যের শিকার। নারীর নিরাপত্তার বৈষম্য আজকাল খুব বাজে ভাবে চোখে পড়ছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নারীদের কাছে নতুন কিছু নয়। নিজের কর্মস্থলে এর থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা কি আর হওয়া সম্ভব?

বসের ফণা তুলে ফোসফোস করা, শিক্ষকের ভক্ষকের মত আচরণ যে নারী একবার দেখেছেন, তিনিই জানেন কত কুৎসিত তাদের দৃষ্টি, কত জঘন্য তাদের ভাষা, কত হিংস্র তাদের স্পর্শ। চক্ষু লজ্জা ও চাকরি হারানোর ভয়ে কত জন যে এ বিষয়টা নিয়ে রিপোর্ট করেন না তার মানে এই নয় কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হচ্ছে না। 

যৌন হয়রানি হতে পারে মৌখিক, লিখিত আবার হতে পারে শারীরিক। অশ্লীল কৌতুক, ফোনে বা ইমেইলে কু ইঙ্গিত, অপ্রীতিকর স্পর্শ, কাজের ছুতোয় শারীরিকভাবে হেনস্থা করা –  আরো অনেক কিছুই এর মধ্যে পড়ে । 

অ্যাকশন এইডের এক জরিপে দেখা যায় যে শহরে বসবাসকারী ৫৪.৭ শতাংশ মহিলা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক সহিংসতার পাশাপাশি পরিচিত বা অপরিচিতদের দ্বারা অযাচিত যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হন। 

কর্মজীবী নারী ও কেয়ার বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় বেড়িয়ে এসেছে আরেক তথ্য – বাংলাদেশের ১২.৭ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির  শিকার হন। প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। শুধুমাত্র যারা নিজে এগিয়ে এসে কর্মক্ষেত্রে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন, তাদের নিয়ে করা হয়েছে এই সমীক্ষা। তারা নিজেরাও বলেছেন তাদের মত আরও অনেকে আছে যারা মুখ খোলেন নি। আর সংখ্যাটা তাদেরই বেশি। বয়স, ভৌগলিক অবস্থান, পেশা নির্বিশেষে কেউ এর বাইরে নন। শহরে, গ্রামে, পাহাড়ে কোথায় নেই এর ভয়াল গ্রাস!

অবাক করা ব্যাপার হল পুলিশে কর্মরত নারী সদস্যদেরও এমন জঘন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারা মুখ খোলার সাহস পাননি কারণ অপরপক্ষ বেশ ক্ষমতাবান ছিল। মুখ খুললে হয়তো বড় কর্তা দোষটা দেবেন তারই ঘাড়ে। ২০১৭ সালে কনস্টেবল হালিমা বেগম এক পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের হাতে ধর্ষিত হন। তার আত্নহত্যার পর বেড়িয়ে আসে এসব তথ্য।

ক্ষমতার বিভাজনে (Power Dynamics) একটা বড় বিভেদ আছে কর্মক্ষেত্রে। পুরুষ মাত্রই বেশি শক্তিশালী, তাদের ক্ষমতাও বেশি – এরকম ভুল ধারণা বিরাজমান সবার মধ্যে। এমন অনেক পুরুষ কর্মী আছেন যারা ভাবেন আমি যা খুশি তাই করতে পারি, দুর্বল নারী সহকর্মী কি আর এমন বাধা দেবে। অনেক নারীও নিজেকে শক্তিহীন ভেবে চুপ থাকেন। দু’টো বাজে কথা বা ইংগিতে তারা অন্য ব্রাঞ্চে বদলীর আবেদন করেন, কিন্তু মুখ খুলে অভিযোগ করেন না। চাকরি হারানোর ভয় তো থাকেই। উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত নারীরাও রেহাই পান না। 

স্বনামধন্য একটি কোম্পানির জনসম্পদ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা (নারী) জানালেন, “ওরা (অফিসের পুরুষ কর্মী) আমার সামনে গা বাঁচিয়ে চলে ঠিকই, কিন্তু একদিন থ্রিপিস বাদ দিয়ে ফতুয়া পরে অফিসে এলেই কুনজর আর বাজে কথা আমার কানে ভেসে আসে। আমারই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে আমাদের অধীনস্থরা কেমন আছে, ইন্টার্নরা কেমন আছে? এ ভেবেই আমি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এর বিষয় গুলো দেখার জন্য একটা কমিটি গঠনের চেষ্টা করছি। প্রস্তাবনা অনুমোদন হয়ে গেছে, শুধু এর পরের কাজ গুলো বাকি”

ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে মনিরা সুলতানার একটি ছবি ক’দিন আগে এক পত্রিকার বদৌলতে ভাইরাল হয়েছিল। নিউজ ফিডে আসার আগ পর্যন্ত ওনার নামটাও কেউ জানত না। তিনি এক সময় একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেখানেই হয়েছিলেন যৌন হয়রানির শিকার। আওয়াজও তুলেছিলেন। সে আওয়াজ কেউ শোনে নি, উল্টো হারিয়েছিলেন চাকরি। শাহবাগে ধর্ষকদের বিচারের দাবীর আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক সোচ্চার কন্ঠ। তার চোখের পানি কাঁদিয়েছে অনেক কর্মজীবী নারীকে, যারা তার মতোই ভুক্তভোগী। 

দেশের প্রথম সারির একটি ফাইন্যান্স কোম্পানিতে কাজ করতেন সুমি (ছদ্মনাম)। বাড়ি থেকে বেশদূরে তার অফিস। তাই সবার মতো অফিসের বাসেই চলাফেরা করতেন। এরপর লক্ষ্য করলেন তার উর্দ্বতন একজন প্রায়ই অফিসের সময় শেষ হওয়ার পরও কাজের ছুতোয় আটকে রাখেন। বাস মিস করলে লিফট দিতে চান। একদিন সুযোগ বুঝে আপত্তিকরভাবে গায়ে হাতও দিলেন। এত বড় ধাক্কার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।   

প্রথম অভিযোগে অফিসের কেউ গা করল না। সুমি শরণাপন্ন হলেন পুলিশের। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১০ ধারায় মামলা করলেন। অনেক ভোগনোর পর পুলিশ একদিন অফিসে এসে চা নাস্তা খেয়ে বিদায় নিলেন। সুমিকে বললেন আপোস করে মামলা তুলে নিতে। সবার টনক যখন বিষয়টা বহুদূর গড়িয়ে গিয়েছে, হস্তক্ষেপ করেছেন ক্ষমতাসীন এক ব্যক্তি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আত্নীয় হওয়ায় সে যাত্রায় সুমির ভাগ্যে সুবিচার জুটেছিল। কিন্তু যাদের এমনটা নেই? আমাদের পুরুষশাষিত সমাজ ধরেই নিয়েছে গায়ে হাত দেওয়া, অশ্লীল ইংগিত এগুলো পুলিশতক গড়ানোর মত বড় বিষয় না। যতদিন না এই দৃষ্টিভংগি দূর হচ্ছে, ততদিন নারীর মুক্তি নেই।

বাংলাদেশে এখনো কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট আইন নেই, তবে ২০০৯ সালে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়ে আলোকপাত করে হাইকোর্টে এগারো পয়েন্টের একটি আদেশনামা জারি হয়েছে। এই এগারো পয়েন্টের প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং সে পরিস্থিতিতে করণীয় সবকিছু সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে।

তবে ১১বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও  এর সিকি ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কমিটি তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু অফিসগুলোয় এখনো নেই কোন গাইডলাইন। গার্মেন্টস গুলোতে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের কথা আমাদের কানে প্রায়ই ভেসে আসে। পেটের দায়ে, চাকরি হারানোর ভয়ে তারা কেউ মুখ খোলেন না। গাইডলাইন তো দূরে থাক, অভিযোগ করলেও উল্টো দোষ এসে পড়ে অভিযোগকারীর ঘাড়ে। আমাদের দেশের কর্পোরেট সেক্টরেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া যৌন হয়রানি বিষয়ক গাইডলাইনের দেখা মেলে না। 

২ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার ইনস্টিটিউট অফ মর্ডান লঙ্গুয়েজেস এর একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। তিনি ছিলেন জার্মান ল্যাঙ্গুয়েজের একজন সাবস্টিটিউট টিচার। স্কলার্শিপ ও জার্মান এমব্যাসি তে কাজের সুযোগ করে দেবেন এমন মুলো ঝুলিয়ে তিনি ছাত্রীদের উপর সুযোগ নিতেন। প্রশংসা করার ছলে জড়িয়ে ধরতেন, সাথে অপ্রীতিকর স্পর্শ তো ছিলই। 

এ আচরণ গুলোকে কেউ প্রথমে পাত্তা দেননি। কারণ ঐ শিক্ষকের বয়স ছিল ৭০ এর উপরে। ছাত্রীদের তিনি নাতনির চোখে দেখেন বলে দাবি করতেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ছাত্রী বলেন, একদিন ক্লাস শেষে তার ডাক পড়ে ওনার রুমে। এরপর প্রথম সুযোগেই তিনি হাত নিয়ে যান ছাত্রীর জামার ভেতর। তবে ঐদিন আর তিনি পার পাননি। ছাত্রীর হাতের চপেটাঘাতে লাল হয়েছিল ওনার গাল।   

পরবর্তীতে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আরো অনেক ছাত্রী তাদের যৌন হয়রানির কথা তুলে ধরেন। চাকরি হারান এই শিক্ষক নামের ভক্ষক। তবে এতদিন পর ওই ছাত্রী আক্ষেপ করে বললেন-  “আমার শুধু এটাই মনে হয় ওই লোকটাকে আমরা ঠিকভাবে পানিশড করতে পারিনি। তার শুধু চাকরিটাই গিয়েছে। কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তার আসল রূপটা আরো দশটা মানুষ জানতেও পারেনি। হয়তো তিনি আবারো কারো উপর এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।”  

এ পর্যন্ত যতগুলো শ্যাডো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সবগুলোতেই বারবার  জানতে চাওয়া হচ্ছে ২০০৯ এর আদেশনামার সঠিক বাস্তবায়ন এখনো হয়নি কেন। উত্তরটা কারো জানা নেই। এখন দরকার একটি যথোপযুক্ত আইন। আর যতদিন না নতুন আইন পাস হচ্ছে, এগারো পয়েন্টের প্রত্যেকটির  বাস্তব জীবনে যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিটি অফিস নারী বান্ধব কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আলাদা কমিটি থাকতে হবে। এই কমিটির শুধু নামের কমিটি হলে চলবে না, নিয়মিত শুনতে হবে কারো কোন অভিযোগ আছে কিনা। পক্ষপাতদুষ্টতা বাদ দিয়ে সবাইকে যদি এই কমিটির পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা যায় তাহলেই কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন হয়রানির বিপক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। 

 

This blog is part of our campaign to raise awareness on rape culture in society, called Ashche Notun Bhor. It is a part of our fellowship with the Centre of Excellence for Gender, Sexual and Reproductive Health Rights, BRAC University James P. Grant School of Public Health, and BLAST, funded by CREA.

This Post Has 2 Comments

  1. If you want to use the photo it would also be good to check with the artist beforehand in case it is subject to copyright. Best wishes. Aaren Reggis Sela

  2. erotik

    There is certainly a lot to learn about this issue. I love all of the pointgs you made. Estella Roderich Rosa

Leave a Reply